ইসলামে দাসীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক কেন হালাল?
ইসলামে দাসী-সঙ্গম হালাল হওয়ার বিষয়টি একটি জটিল ঐতিহাসিক ও আইনগত প্রেক্ষাপটের
সাথে জড়িত। তৎকালীন সময়ে প্রচলিত দাসপ্রথা এবং যুদ্ধকেন্দ্রিক সামাজিক কাঠামোকে
বুঝতে পারলে এর কারণগুলো অনুধাবন করা সহজ হয়। তৎকালীন বিশ্বে, বিশেষ করে ৭ম
শতাব্দীর আরবে, দাসপ্রথা একটি প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা ছিল।
যুদ্ধবন্দীদের দাস বা দাসী হিসেবে গণ্য করা হতো। ইসলাম এই প্রথাকে নিয়ন্ত্রণের
মধ্যে এনেছে এবং দাস-দাসীদের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে।
চলুন প্রথমে আমরা বর্তমান সময়ে যুদ্ধ বন্দী নারীদের চিত্র দেখে আসি ।
জেনেভা কনভেনশন: ১৯৪৯ সালের তৃতীয় জেনেভা কনভেনশন, যুদ্ধবন্দীদের
(Prisoners of War - POW) সাথে মানবিক আচরণের নিয়মাবলী নির্ধারণ করে। এই
আন্তর্জাতিক আইনটি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল যুদ্ধবন্দীর অধিকার রক্ষা করে।
যুদ্ধবন্দী নারীদের বিষয়ে জেনেভা কনভেনশনে যা বলা হয়েছে তার মূল বিষয়গুলো
হলো:
১. সম্মান ও মানবিক আচরণ: যুদ্ধবন্দী নারীদের সাথে তাদের লিঙ্গের প্রতি
যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। তাদের সাথে কোনো অবস্থাতেই অমানবিক, অপমানজনক বা
সহিংস আচরণ করা যাবে না। পুরুষ যুদ্ধবন্দীদের তুলনায় তাদের প্রতি সমান বা আরও বেশি
অনুকূল আচরণ নিশ্চিত করতে হবে।
২. বিশেষ সুরক্ষা: কনভেনশনে স্পষ্টভাবে বলা
আছে যে, নারীদের সম্মানকে যেকোনো ধরনের আক্রমণ থেকে বিশেষভাবে রক্ষা করতে হবে। এর
মধ্যে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি বা যেকোনো ধরনের অশালীন আক্রমণ
অন্তর্ভুক্ত। এই ধরনের কাজকে গুরুতর যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
৩. পৃথক আবাসন: নারী যুদ্ধবন্দীদের জন্য পুরুষদের থেকে আলাদা বাসস্থানের
ব্যবস্থা করতে হবে (যদি না তারা পরিবারের সাথে বন্দী থাকে)। তাদের তত্ত্বাবধানের
দায়িত্বে নারীদেরই রাখতে হবে, যাতে তাদের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষা পায়।
৪. স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা: যুদ্ধবন্দী নারীদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে
বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে, বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও মায়েদের ক্ষেত্রে। তাদের বয়স,
লিঙ্গ এবং স্বাস্থ্যের অবস্থা বিবেচনা করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. জিজ্ঞাসাবাদ: জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের উপর কোনো প্রকার শারীরিক বা
মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। তাদের নাম, পদ, জন্মতারিখ ও সিরিয়াল নম্বরের বাইরে
অন্য কোনো তথ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না।
সোর্সের লিঙ্ক:
International Committee of the Red Cross (ICRC) - Third Geneva Convention
(এটি চুক্তির মূল ইংরেজি টেক্সট)
ICRC হলো জেনেভা কনভেনশনগুলোর তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা, তাই তাদের ওয়েবসাইট সবচেয়ে
নির্ভরযোগ্য উৎস।
এটাতো কেবলমাত্র লিখিত নিয়মের কথা। এই কথাগুলো শুনতে যতটা Perfect মনে হচ্ছে
বাস্তবতা ততটাই জঘন্য। বাস্তবে যুদ্ধবন্দী নারীদের সাথে কতটা জঘন্য আচরণ করা সে
সম্পর্কে একটু ধারণা নেয়া যাক।
ইউক্রেন
বিস্তারিত তথ্য ও সংখ্যা: জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিসের
(OHCHR) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে রুশ সৈন্যরা যুদ্ধাপরাধ করেছে। ঐ প্রতিবেদনে
একটি নির্দিষ্ট সময়ে ১০২টি যৌন সহিংসতার ঘটনা যাচাই ও নথিভুক্ত করার কথা
উল্লেখ করা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের বয়স ৪ থেকে ৮২ বছর পর্যন্ত।তবে এটা শুধু
লাইভ ইন্টারভিউ নিয়ে যাচাই ও নথিভুক্ত করা সংখ্যা । বাস্তবে এই সংখ্যা আনুমানিক
কয়েক হাজার বা তারও বেশি ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সুদান বিস্তারিত তথ্য ও সংখ্যা: জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা একটি
বিবৃতিতে জানিয়েছেন যে তারা সুদানে, বিশেষ করে র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF)
দ্বারা নারী ও মেয়েদের ওপর ব্যাপকহারে ধর্ষণ ও যৌন দাসত্বের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ
পেয়েছেন। তাদের মতে, শুধুমাত্র খার্তুমেই ৫৭টি ভিন্ন ঘটনায় অন্ততপক্ষে
১৩৭ জন নারী ও মেয়েকে ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়েছে।
বাস্তবে এই সংখ্যা আনুমানিক কয়েক হাজার বা তারও বেশি ছাড়িয়ে যেতে পারে।
মিয়ানমার বিস্তারিত তথ্য ও সংখ্যা: জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন তাদের
রিপোর্টে Rohingya জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর চালানো যৌন সহিংসতাকে
"ব্যাপক ও পদ্ধতিগত" (widespread and systematic) এবং "গণহত্যার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত"
(genocidal intent) হিসেবে বর্ণনা করেছে।
সহিংসতার মাত্রা এতটাই ব্যাপক ছিল যে, কোনো নির্দিষ্ট চূড়ান্ত সংখ্যা দেওয়া
হয়নি কারণ তা প্রকৃত ভয়াবহতার প্রতিনিধিত্ব করবে না। রিপোর্টটি হাজার হাজার ভুক্তভোগীর সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র (DRC) বিস্তারিত তথ্য ও সংখ্যা: পূর্ব কঙ্গোর
সংঘাতকে প্রায়শই "বিশ্বের ধর্ষণ রাজধানী" হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যেখানে কয়েক দশক
ধরে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী (যেমন M23, ADF) এবং এমনকি সরকারি বাহিনীর সদস্যরাও যৌন
সহিংসতাকে যুদ্ধের একটি প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এটি শুধুমাত্র
ধর্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি এবং ভয়াবহ
অঙ্গহানির মতো ঘটনাও এর অন্তর্ভুক্ত। এর মূল উদ্দেশ্য হলো সম্প্রদায়কে ভেঙে
দেওয়া, terror সৃষ্টি করা এবং এলাকা দখল করা। জাতিসংঘের তথ্যমতে, শুধুমাত্র ২০২২
সালেই দেশটিতে ৮,০০০-এর বেশি যৌন সহিংসতার ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে।
এই তথ্যের ভয়াবহতা থেকে
আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে জেনেভা কনভেনশন কেবলমাত্র একটি লিখিত নিয়ম
এর বাইরে আর কিছুই না। এখন পর্যন্ত
এমন কোনো আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘাতের উদাহরণ পাওয়া যায়নি যেখানে জেনেভা
কনভেনশনের সকল আইন সব পক্ষ দ্বারা ‘সম্পূর্ণরূপে’ বা ‘ত্রুটিহীনভাবে’ অনুসরণ করা
হয়েছে।
এর কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে: জেনেভা কনভেনশনের আইন গুলো কিছুটা এমন যে,
আপনাকে বলা হলো আপনাকে জলন্ত আগুনের উপরে একটা ঝুলন্ত রশি ধরে অনির্দিষ্ট সময়ের
জন্য ঝুলে থাকতে হবে। রশি ছেড়ে দিলে আগুনে পরে আপনার নিশ্চিত মৃত্যু। কয়েক
সেকেন্ড, কয়েক মিনিট কিংবা কয়েক ঘন্টা নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও হাত আপনি ছাড়বেন।
তার একমাত্র কারণ হচ্ছে এই সম্পূর্ণ প্রসেসটি একটা না একটা সময় আপনার ধৈর্য এবং
সহ্য শক্তির বাইরে চলে যাবে। এই কথা বলার পিছনে আমার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, একটা
মানুষ নিজেকে কতটা সংযত রাখতে পারবে তা সবচেয়ে ভালো একমাত্র মহান আল্লাহ পাকই
জানেন ।আর সে কারণেই যুদ্ধ বন্দীদের ক্ষেত্রে ইসলামে বর্ণিত দাস প্রথাই সর্বোচ্চ
কল্যাণকর এবং এখনো পর্যন্ত এরচেয়ে ভাল কোন সমাধান বের করা সম্ভব হয়নি।
দাসপ্রথার পেছনের মূল কারণ এবং এর ভাল দিকগুলো:
১. যুদ্ধবন্দীদের অবস্থা: তৎকালীন এমনকি বর্তমান সময়ে যুদ্ধে পরাজিত পক্ষের
নারীরা অন্যায় অবিচার আর গণধর্ষণের শিকার হয়ে থাকে। ইসলাম এই নারীদেরকে যৌন শোষণ
বা গণধর্ষণের মতো পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করার জন্য নির্দিষ্ট আইনগত কাঠামো দেয়। এর
মাধ্যমে একজন নারী শুধুমাত্র তার মনিবের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতো, যা তাকে
অন্যদের দ্বারা অত্যাচারিত হওয়া থেকে সুরক্ষা দিত।
২. সামাজিক কাঠামো: যৌন চাহিদা পূরণের জন্য বিবাহ অথবা দাসীর সাথে
সম্পর্ক—এই দুটি পথই বৈধ । এর বাইরে যেকোনো যৌন সম্পর্ক, যেমন—ব্যভিচার বা
পতিতাবৃত্তি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ । যুদ্ধবন্দী নারীদের যেহেতু স্বাভাবিক বিয়ে হওয়ার
সুযোগ কম থাকতো, তাই এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের যৌন ও সামাজিক চাহিদা পূরণের একটি
কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল।
৩. সন্তানের অধিকার: দাসীর গর্ভে তার মনিবের সন্তান
জন্মগ্রহণ করলে সেই সন্তান স্বাধীন হিসেবে গণ্য হতো এবং পিতার সম্পত্তির
উত্তরাধিকারী হতো। এছাড়া, সন্তানের জননী হওয়ার পর সেই দাসীকে আর বিক্রি করা যেত না
এবং মনিবের মৃত্যুর পর তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুক্ত হয়ে যেতেন। এই নিয়মটি দাসীদেরকে
পরোক্ষভাবে মুক্তির একটি পথ করে দিত।
৪. স্বাধীনতা: বর্তমান বিশ্বে
যুদ্ধবন্দীদের যেখানে আবদ্ধ জায়গায় বন্দি করে রাখা হয়, সেখানে ইসলামিক দাস
প্রথায় দাস-দাসীরা নির্দিষ্ট সীমানা ব্যতীত প্রায় মুক্তভাবে চলাফেরার স্বাধীনতা
পেয়ে থাকে।
৫. দাসপ্রথা বিলুপ্তির অনুপ্রেরণা: ইসলাম দাসপ্রথাকে উৎসাহিত
করেনি, বরং বিভিন্নভাবে দাসমুক্তির প্রতি উৎসাহ দিয়েছে। যেমন—কোনো পাপের কাফফারা
হিসেবে দাসমুক্তির বিধান ছিল।
![]() |
| লেখক: সি. জে. আর. |

কোন মন্তব্য নেই